অদ্বিতীয় মার্ক জাকারবার্গ

ইন্টারনেটে গড়ে উঠেছে সামাজিক সম্পর্কের শক্তিশালী এক নেটওয়ার্ক, যে নেটওয়ার্কে বসে হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা আপন মানুষটির সঙ্গে মনের কথা বলা যায়। খুঁজে বের করা যায় হারিয়ে যাওয়া পুরোনো বন্ধুটিকে। সাইবার দুনিয়ায় সামাজিক যোগাযোগের সর্ববৃহৎ এই নেটওয়ার্কের নাম ফেসবুক। ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক এলিয়ট জাকারবার্গ। মাত্র ২৬ বছরের টগবগে এক মার্কিন তরুণ, সফল একজন ব্যবসায়ী। বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী বিলিয়নিয়ার,যিনি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে এক সুতোয় গেঁথেছেন। বিশ্বখ্যাত টাইম সাময়িকীর দৃষ্টিতে মার্ক জাকারবার্গ হয়েছেন ২০১০ সালের ‘পারসন অব দি ইয়ার’।
আজ থেকে দশক চারেক আগে বিজ্ঞানীরা জাতপাতহীন এক ও অভিন্ন বিশ্বের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই দশকের মাঝামাঝি ওই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় কৈশোর উত্তীর্ণ জাকারবার্গের হাত ধরে। ফেসবুক এখন যেন জাতপাতহীন এক ভার্চুয়াল দুনিয়া।
শৈশব ও কৈশোর: ১৯৮৪ সালের ১৪ মে নিউইয়র্কের হোয়াইট প্লেইনস গ্রামে জন্ম মার্কের। বাবা এডওয়ার্ড দন্ত চিকিৎসক। মা কারেন একজন মনোরোগ চিকিৎসক। মার্ক ছাড়াও এডওয়ার্ড-কারেন দম্পতির ঘরে আছে তিন মেয়ে র‌্যান্ডি, ডোনা ও এরিলি। ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করেছেন গাঁয়ে, নিউইয়র্কের ডোবস ফেরিতে। শৈশব থেকেই মার্ক পড়াশোনা ও কাজকর্মে ছিলেন চৌকস।
কৈশোরেই ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসি, হিব্রু, লাতিন ও প্রাচীন গ্রিক ভাষায় কথা বলা ও লেখা শিখে যান মার্ক। কম্পিউটারের প্রতি ঝোঁক দেখে ছেলেকে নিজেই প্রোগ্রামিং শেখানো শুরু করেন এডওয়ার্ড। সে ১৯৯০ সালের কথা। মার্ক তখন ছয় বছরের শিশু। তখনই তাঁকে আটারি বেসিক প্রোগ্রামিংয়ের ওপর পড়ানো শুরু করেন এডওয়ার্ড। পরে একজন গৃহশিক্ষক (সফটওয়্যার নির্মাতা) রেখে দেন। ডেভিড নিউম্যান নামের ওই শিক্ষক জাকারবার্গকে ‘বিস্ময় বালক’ স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি।
যেন আজন্ম প্রোগ্রামার: যোগাযোগের কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং ভিডিও গেম নিয়ে আগ্রহ ছিল জাকারবার্গের। বাবার রোগী দেখার চেম্বার আর বাড়ির গুটিকতক কম্পিউটারের জন্য একটি প্রোগ্রাম বানান জাকারবার্গ। নাম দেন ‘জাকনেট’। এর সাহায্যে ব্যবহারকারীরা সহজেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন। মাধ্যমিকে পড়ার সময় ‘সিনাপস মিডিয়া প্লেয়ার’ নামের একটি মিউজিক প্লেয়ার বানান খুদে এই প্রতিভা। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারী বা শ্রোতার রুচি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যেত। মাইক্রোসফট ও এওল সফটওয়্যারটি কেনার আগ্রহ দেখায়। মার্ককে চাকরিরও প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মার্ক সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং সফটওয়্যারটি আরও উন্নত করতে স্কুল পর্যন্ত ছেড়ে দেন। পরে পড়াশোনা করতে চলে যান হার্ভার্ডে।
ফেসবুকের জন্ম: হার্ভার্ডে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা শুরু করেন জাকারবার্গ। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সহায়ক ‘কোর্সম্যাচ’ নামের একটি সফটওয়্যার তৈরি করেন। কলেজের সুদর্শন তরুণ-তরুণী বাছাই করতে অল্পদিনের মাথায় ‘ফেসম্যাশ’ নামের আরেকটি সফটওয়্যার বানান মার্ক। ছবি দেখে আবেদনময় তরুণ-তরুণী বাছাইয়ের হিড়িক পড়ে যায় গোটা কলেজে। এতে কলেজের ওয়েব সার্ভারে বাড়তি চাপ পড়ে। কর্তৃপক্ষ সাইটটি বন্ধ করে দেয়। শিক্ষার্থীরা দাবি তুললেন, ওই রকম একটি ওয়েবসাইট তাঁদের চাই। যেখানে শিক্ষার্থীদের নাম, ঠিকানা, ছবি ও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের বিস্তারিত তথ্য থাকবে। এ কথা শুনে মার্ক প্রতিজ্ঞা করেন, কলেজ কর্তৃপক্ষ করে না দিলে তিনি নিজে শিক্ষার্থীদের জন্য এমন একটি ওয়েবসাইট তৈরি করবেন। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে গিয়েই জাকারবার্গের হাতে জন্ম নেয় পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বৃহত্তম সামাজিক যোগাযোগের সাইটটি।২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি হার্ভার্ডের ডরমিটরিতে ফেসবুকের উদ্বোধন করেন জাকারবার্গ। গোটা দুনিয়ায় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন ৫৫ কোটি।
ফেসবুক কার্যালয়: ক্যালিফোর্নিয়ার প্যালো আল্টোতে ফেসবুকের বিশাল কার্যালয়।গত মাসে টাইম ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক সেখানে গিয়েছিলেন জাকারবার্গের সাক্ষাৎকার নিতে। তাঁর বর্ণনা এমন—অ্যাকুরিয়ামে (সম্মেলনকক্ষটির এমনই নাম দেওয়া হয়েছে) সহকর্মীদের নিয়ে বৈঠকে বসেছেন মার্ক। সামনে কাগজপত্র নেই। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছেন। তিন দিকে কাচ দিয়ে ঘেরা বিশাল কক্ষটি গোটা অফিসে তাঁদের গোপনীয়তা রক্ষার একমাত্র স্থান। কারণ অফিসটা একেবারে খোলামেলা। পর্দা ও দেয়ালহীন একটি অফিস। কর্মীরা যেন একজন আরেকজনকে সহজে দেখতে পান, পারস্পরিক ভাব বিনিময় করতে পারেন এ জন্যই এমন ব্যবস্থা। সবার জন্য একই ধাঁচের কম্পিউটার ও আসবাব। এমনকি মার্কের জন্য আলাদা বসার কোনো কামরা নেই। অফিসের ছাদ থেকে ঝুলছে বাহারি রঙের শোপিস। না অফিস, না বাড়ি—এমনই একটি আবহ বিরাজ করছে অফিসজুড়ে। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, মার্ককে তাঁরা প্রচণ্ড ভালোবাসেন।
প্রেম: পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি উচ্চতার জাকারবার্গের মুখের ওপর নাকটা রোমান ধাঁচের। কোঁকড়া বাদামি চুলে ঢাকা মাথা। জিনস আর টি-শার্ট তাঁর পছন্দের পোশাক। আর দশটা তরুণের মতো মার্কের জীবনেও প্রেম এসেছে। তাঁর প্রেমিকার নাম প্রিসিলা চ্যান। হার্ভার্ডে পড়ার সময় ২০০৪ সালে প্রিসিলার সঙ্গে পরিচয় মার্কের। সেই পরিচয় থেকে প্রণয়। বর্তমানে দুজন এক সঙ্গে থাকছেন।
উদার হূদয়ের এক তরুণ: এত অল্প বয়সে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ মাথা ঘুরিয়ে দেয়নি মার্কের। উচ্চাভিলাষী কোনো চিন্তাভাবনা নেই তাঁর। হতে চান একজন সাদাসিধা মানুষ। সুযোগ পেলে মা-বাবা, ভাই-বোনকে নিয়ে ঘুরতে বের হন। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটের মতো ধনকুবেরদের সঙ্গে মিলে তরুণ এই প্রযুক্তিবিদ একটি চুক্তি সই করেছেন। নৈতিক ওই চুক্তিতে মার্ক জাকারবার্গ তাঁর জীবনের অর্ধেক সম্পত্তি দাতব্য কাজে দান করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। ফেসবুকের মতোই শ্রেণীবৈষম্যহীন এক বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন জাকারবার্গ, যেখানে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণগুলো আরও জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠবে।

ফেসবুক তথ্য কণিকা
 মার্ক জাকারবার্গ বর্ণান্ধ। লাল-সবুজ রং ভালো দেখতে পান না। তবে নীল রংটা ভালো দেখেন। তাই ফেসবুকে নীল রঙের এত আধিক্য।
 সক্রিয় ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৫ কোটি। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি ব্যবহারকারী রোজ তাদের স্ট্যাটাস হালানাগাদ করে। প্রতিদিন সাড়ে পাঁচ কোটিরও বেশি স্ট্যাটাস আপডেট হয়।
 মাসে ২৫০ কোটির বেশি ছবি রাখা হয় ফেসবুকে।
 মার্কিনরা ফেসবুকের পেছনে বছরে এক হাজার ৩৯০ কোটি মিনিট ব্যয় করে।
 ফেসবুক একটি দেশ হলে এটি হতো চীন ও ভারতের পর পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যা-অধ্যুষিত দেশ।
 সিরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম ও ইরানে ফেসবুক নিষিদ্ধ।

কালে কালে ফেসবুক
২০০৪: ফেব্রুয়ারিতে হার্ভার্ডের ডরমিটরিতে ফেসবুকের উদ্বোধন করেন এর চার প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ, ডাস্টিন মস্কোভিৎজ, চেরিস হুগেস ও এডোয়ার্ডো স্যাভেরিন।
জুনে প্যালো আল্টোতে অফিস নেওয়া হয়।
ডিসেম্বরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখে পৌঁছায়।
২০০৫: আগস্টে ‘দ্য ফেসবুক ডটকম’ নাম পাল্টে কোম্পানির নাম রাখা হয় শুধু ‘ফেসবুক’।
ডিসেম্বরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৫ লাখ।
২০০৬: কৌশলগত কারণে আগস্টে ফেসবুকের সঙ্গে মাইক্রোসফট সম্পর্ক স্থাপন করে। সেপ্টেম্বর থেকে সর্বসাধারণের জন্য ফেসবুক উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আগে শুধু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই ছিলেন এর ব্যবহারকারী।
ডিসেম্বরে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ২০ লাখে।
২০০৭: ফেব্রুয়ারিতে ভার্চুয়াল গিফট শপ চালু হয়।
এপ্রিলে ব্যবহারকারীর সংখ্যা পৌঁছায় দুই কোটি।
২০০৮: কানাডা ও ব্রিটেনের পর ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্স ও স্পেনে ফেসবুকের ব্যবহার শুরু হয়।
এপ্রিলে ফেসবুক চ্যাট চালু হয়।
আগস্টে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ কোটিতে।
২০০৯: জানুয়ারিতে ব্যবহারকারী ১৫ কোটি।
ডিসেম্বরে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩৫ কোটিতে।
২০১০: ফেব্রুয়ারিতে যে সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি, জুলাইয়ে সেই সংখ্যা ৫০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। আর ডিসেম্বরে এ সংখ্যা ৫৫ কোটি।

দি সোশ্যাল নেটওয়ার্ক
মার্ক জাকারবার্গের জীবনী অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ছবির নাম দ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। চলতি বছরের ১ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া ছবিটি পরিচালনা করেছেন ডেভিড ফিঞ্চার। ছবিটি দেখে জাকারবার্গ যারপরনাই হতাশ। কারণ, ছবির মার্ক আর বাস্তবের মার্কের মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। ছবিতে মার্ককে একজন উচ্চাভিলাষী তরুণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যিনি তাঁর প্রতিভাকে নারী, অর্থ ও আমোদে-ফুর্তিতে গা ভাসাতে ব্যবহার করেছেন। ছবিটি দেখে জাকারবার্গ হতাশ কণ্ঠে শুধু একটি মন্তব্যই করেছেন, ‘আমার জীবদ্দশায় এমন ছবি যেন আর কেউ না বানায়।’

একনজরে মার্ক জাকারবার্গ
পুরো নাম: মার্ক এলিয়ট জাকারবার্গ
জন্ম তারিখ: ১৪ মে ১৯৮৪
জন্মস্থান: হোয়াইট প্লেইনস, নিউইয়র্ক
বর্তমান আবাস: প্যালো আল্টো, ক্যালিফোর্নিয়া
পড়াশোনা: কম্পিউটার বিজ্ঞান, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়
পেশা: ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাকাল: ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪
সদস্যসংখ্যা: ৫৫ কোটি (২০১০ পর্যন্ত)
ফেসবুকের কর্মীর সংখ্যা: দুই হাজার
মার্কের সম্পদের পরিমাণ: ৬৯০ কোটি ডলার
স্বীকৃতি: ২০১০ সালের সেরা ব্যক্তিত্ব (টাইম)।বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ ধনবান (ফোর্বস)।
টাইম এবং একাধিক ওয়েবসাইট অবলম্বনে

Copyright © 2009 - www.techzoom7.tk - is proudly powered by Blogger
Smashing Magazine - Design Disease - Blog and Web - Dilectio Blogger Template